..
এক সপ্তাহের লম্বা ছুটি থেকে ফিরে থানায় জয়েন করেই একটা ইন্টারেষ্টিং কেস হাতে পেলো মুস্তাকিম।
কোঁকড়ানো চুল, একটু শর্ট হাইটের মেয়েটি তারই অপেক্ষায় বসে ছিলো। মুখেচোখে বেশ একটা জৌলুশ আছে যা দু'বার ঘুরে দেখতে বাধ্য করে। মুস্তাকিমকে ঢুকতে দেখেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। "আপনিই কি ও.সি. মুস্তাকিম? "
"হ্যাঁ, বলুন কী ব্যাপার ?" মুস্তাকিম চেয়ার টেনে বসলো নিজের জায়গায়।
"দেখুন, আমি কাছাকাছি অঞ্চলেই থাকি। আপনি তো ছিলেন না গতকাল বা পরশু। আমি দুই দিন এসে এসে ফিরে গেছি। এখানে একটা ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে, শুনেছেন কিনা জানি না। একটা অ্যাক্সিডেন্ট এর ঘটনা -"
"সাদিয়া আহমেদের কেস?"
মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে বললো, "ওহ আপনি জানেন তাহলে ?"
"হ্যাঁ। ওভার দ্য ফোন শুনেছি। আপনি কী বলতে এসেছেন সেটা বলুন।" এই বলে মুস্তাকিম একজন পিওনকে সাদিয়ার ফাইলটা আনতে বললো। তারপর আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলো, "কী নাম আপনার ?"
"আমার নাম... দেখুন - আমি যেটা বলতে এসেছি তার সাথে হয়তো আমার নামের খুব একটা সম্পর্ক নেই। মানে আমার নাম বলতে কোনো অসুবিধা নেই। দরকার হলে বলবো। আমি একটা তথ্য আপনাকে দিতে এসেছি।"
মুস্তাকিম আগন্তুককে একবার দেখলো ভালো করে। তারপর বললো, "কী তথ্য ?"
"আমি... মানে সাদিয়া আর আমি ভালো বন্ধু ছিলাম আসলে। ফেসবুক থেকে আমাদের পরিচয়। তারপর খুব তাড়াতাড়িই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। মাঝে মাঝে একসাথে সিনেমায় বা শপিং-এ যেতাম দু'জনে মিলে। সাদিয়ার বাড়িতে কেউ জানতো না এই ব্যাপারে। ওর বাবা-মা খুব চোখে চোখে রাখতো । তো ঘুরতে গেলে বাড়িতে টিউশানের নাম করে বের হতো সাদিয়া। সেদিনও ওইরকমই বেরিয়েছিলো।"
মুস্তাকিম আঁচ করলো যে ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলজনক হয়ে উঠছে। সে সোজা হয়ে বসলো।
আগন্তুক বললো, "ঘটনার দিন সাদিয়া আমাকে বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছিলো। মেলার ছবি। মিলনমেলায় একাই গিয়েছিলো ও। আমার যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শেষমুহূর্তে অফিসে আটকে পড়ি। তো ও বাড়ি ফিরে না গিয়ে একাই যায় মেলায়। ওখানে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলো মেলার। আমাকে সেগুলো পাঠিয়েছিলো। তারপর ওর ফোন থেকে ছবিগুলো ডিলিট করে দেয়। বাড়ির ভয়ে। বাড়িতে জানতো না যে মেলায় যাবে। জানতো পড়তে যাচ্ছে। আপনারা নিশ্চয়ই ওর ফোন চেক করেছেন এবং কিছু পাননি। তাই আমি মেলার এই ছবিগুলো আপনাকে দেখাবার জন্য নিয়ে এসেছি। আপনার নাম শুনেছি অনেক -"
মেয়েটি তার ফোন থেকে কিছু ছবি বার করে মুস্তাকিমর সামনে রাখলো ফোনটা। তারপর বলতে থাকলো -
"সবাই এটাকে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু বলেই ধরছে। আমিও প্রথমে তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভালো করে এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে আমি একটা জিনিষ খেয়াল করলাম। দেখুন - বেশ কয়েকটা ছবিতে একটা গ্রীন কালারের টি-শার্ট পড়া ছেলেকে দেখা যাচ্ছে অনেক দূরে। মুখ তো বোঝা যাচ্ছে না ভালো। কয়েকটাতে মাথাও কাটা গেছে, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে যে সেই একই ব্যক্তি। আর সোজা এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে সবসময়।"
মুস্তাকিম ফোনটা নিয়ে ছবিগুলো দেখলো। কথাটা ভুল নয়। এই ছবিগুলো সত্যিই এই কেসটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারে। ইন্সপেক্টর সুমন তো এটাকে অ্যাক্সিডেন্টের কেস বলে ধরে নিয়ে ক্লোজ করে দিয়ে গেছেন।
আগন্তুক মেয়েটি বললো, "কেউ মনে হয় ওকে ফলো করছিলো। সাদিয়া বুঝতে পারেনি নিশ্চয়ই, নাহলে আমাকে বলতো তখনই। ফলো করছিলো মানে নিশ্চয়ই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো তার। এসব ভেবেই আমার মনে হলো যে এটা হয়তো শুধুই অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা নাও হতে পারে। কিছু রহস্য থাকলেও থাকতে পারে।আপনি কি মনে করেন?"
মুস্তাকিম তার পেশাগত দক্ষতায় মাথা নেড়ে বললো, "আমি বুঝতে পারছি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জন্য আপনি খুবই উদ্বিগ্ন। নানারকম কল্পনা আপনার মনে ঘুরছে হয়তো। কিন্তু মেলায় বহু লোক আসে আর সেখানে ছবি তুললে অনেকেই সেই ছবিতে এসে যেতে পারে। তার মধ্যে একজনকে বিশেষভাবে সন্দেহ করা - ব্যাপারটা যুক্তির দিক থেকে খুব ধারালো কি ?"
আগন্তুক একটু ভেবে বললো, "মেলায় মানুষ যায় আনন্দ করতে। যে যার মতো ঘোরাফেরা করে । এভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে না সবসময়। এগারোটা ছবির মধ্যে সাতটাতেই আমরা দেখতে পারছি সেই ব্যক্তি উপস্থিত। হয়তো এটা স্বাভাবিক, হয়তো নয়। কিন্তু একটু বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি কী ?"
মুস্তাকিম এবার জিজ্ঞাসা করলো, "আপনার আত্মপরিচয় দিতে না চাইবার কী কারণ আছে জানতে পারি কি ?"
"কিছুই না। দেখুন সাদিয়ার বাবা-মা আমার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এখন সাদিয়ার এভাবে মৃত্যুর পরে যদি তারা আমার সম্পর্কে জানতে পারেন, প্রথমতঃ তাদের চোখে সাদিয়া হয়তো খুব ছোট হয়ে যাবে। বাড়িতে গোপন করে এভাবে বিভিন্ন জায়গায় যেত। তাছাড়া, তারা আমাকেও সন্দেহ করতে পারেন। ভাববেন আমিই হয়তো কোনোভাবে যুক্ত। তাদের আমি দোষ দিতে পারি না। কতকিছুই তো ঘটছে সমাজের চারদিকে। সেখানে তারা আমাকে কীভাবেই বা বিশ্বাস করবেন ? সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম খিচুড়ি হয়ে যাবে। আমিও তো একজন মেয়ে, তারা আমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে থাকলে আমার বাড়িতেও সমস্যা তৈরী হবে। আমি শুধু চাই, যদি সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকে, তো সে চিহ্নিত হোক এবং শাস্তি পাক।"
"আপনি চাকরি করেন বললেন, তাই না ? কোথায় জব আপনার ?" মুস্তাকিম জিজ্ঞাসা করলো।
"আমি গ্রাজুয়েশনের সাথে সাথে পার্টটাইম জব করছি একটা ফার্মে কিছুদিন হলো। অমেইক আইটি । হাউসবিল্ডিং কাছে আমার অফিস।"
মুস্তাকিম মেয়েটিকে অভয় দিয়ে বললো, "ঠিক আছে, আপনার পরিচয় গোপন রাখা আমার দায়িত্ব রইলো। চিন্তা করবেন না, আমি দেখে নিচ্ছি। আপনার সামনে আমার নাম্বার লেখা আছে দেখুন। আপনি ছবিগুলো এই নাম্বারে পাঠিয়ে দিন ততক্ষণে। "
…………………………………………………………
মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে কেস ফাইলটা খুললো মুস্তাকিম। সে যখন ছুটিতে গিয়েছিলো, । সুমন অস্থায়ীভাবে তার জায়গায় ছিলেন। ফাইলে তারই হস্তাক্ষর।
গত বুধবারের ঘটনা। নাম সাদিয়া সাহা। বয়স বাইশ। পাঁচ ফুট দু'ইঞ্চি হাইট। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নাগরদোলা থেকে পড়ে মৃত্যু। উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলা বা হুইল বলা হয় যাকে। পুলিশ রিপোর্ট বলছে, মৃতার বাবার তরফ থেকে থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে বিকেল চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। মুখ-চোখ সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে, থেঁতলে গেছে। সেই ছবিই সাঁটানো আছে ফাইলে। পুলিশি অ্যাকশান বলতে, ওই মেলাপ্রাঙ্গনে সব নাগরদোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে ইলেকট্রিক নাগরদোলা থেকে পড়ে সাদিয়া সাহার মৃত্যু হয়েছে, সেই নাগরদোলার মালিক পলাতক। নাম হাফিজ । বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। নাগরদোলা কোথাও ভাঙেনি বা কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে যে সীট থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে সাদিয়ার, তার সেফটি লকটা খোলা ছিলো। কীভাবে খুললো, সেটা বোঝা যায়নি যদিও। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, মস্তিষ্কে তীব্র আঘাত লাগা থেকে মৃত্যু ঘটেছে। কোনো উঁচু জায়গা থেকে পড়লে যা হতে পারে।
এগুলো সবই জানা ছিলো মুস্তাকিমর। থানা থেকে ফোনে বিস্তারিত খবর দেওয়া হয়েছিলো। ইন্সপেক্টর সুমন তার সাথে আলোচনাও করেছিলেন যখন মুস্তাকিম ছুটিতে ছিলো গত সপ্তাহে। তবু ফাইলটা খুলে নাড়াচাড়া করছিলো সে। একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সে, "কোনো বয়ফ্রেন্ড বা ওরকম কোনো রিলেশান কি ছিলো সাদিয়ার ?"
"দেখুন, আমি তো সেরকম জানি না। যদিও মেয়েরা এই ব্যাপারে খুব অন্তর্মুখীন হয়, তবু কিছু থাকলে আমাকে অন্তত বলতোই। না, সেরকম কোনো রিলেশানে ছিলো না ও।"
"তাহলে আপনি যে বলছেন এটা অ্যাক্সিডেন্ট নাও হতে পারে, হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে, তার তো কোনো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেন এরকম করবে ?"
মেয়েটি একটু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ছিলো একজন। ঠিক কোনো সম্পর্ক নয়। ওদের পাড়ারই ছেলে। সাদিয়ার থেকে বয়সে বেশ বড়ো। সাদিয়ার সাথে জোরজবরদস্তি করবার চেষ্টা করেছিলো একবার, পুজোর সময়। বেশ ঝামেলা হয়েছিলো সেবার। আর ছেলেটাকে খুব অপমান করেছিলো সাদিয়া। কিন্তু পরে ছেলেটা বাড়িতে এসে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ব্যাপারটা দুই বাড়ির মধ্যে মিটমাটও হয়ে গিয়েছিলো। তবু পুরোনো রাগ থেকে থাকতেই পারে।"
"আপনি বলছেন সেই ছেলেটাই এই মেলায় গিয়েছিলো আর সাদিয়াকে ইলেকট্রিক নাগরদোলা থেকে সে-ই ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ? কোনো সাক্ষ্য প্রমান কিছু কিন্তু নেই। রিপোর্টে আমি যা দেখছি, প্রতক্ষ্যদর্শীদের বয়ানমতো, মেয়েটি নাগরদোলার সীটে একাই ছিলো, তার সাথে কেউ ছিলো না।"
আগন্তুক মেয়েটি একটু মৃদু হেসে বললো, "ভেবে দেখুন, একটা বিশাল উঁচু নাগরদোলা খুব জোরে ঘুরছে। সেখান থেকে কেউ ছিটকে পড়লে, লোকে তো তার দিকেই দেখবে আতঙ্কে! কোথা থেকে পড়লো, কীভাবে পড়লো, কে নজর করে দেখছে ? অধিকাংশজনই তো দেখতে পাবে পড়ার পরে। সঙ্গে কেউ ছিলো কি ছিলো না এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে কেউ নিজে থেকে এগিয়ে এলো কিনা সঙ্গী হিসাবে। কেউ আসেনি, তার মানে কেউ সাথে ছিলো না। এভাবেই ভাববে মানুষ, তাই না ?"
মুস্তাকিম ভেবে দেখলো, কথাটা ঠিক। পুলিশ খুব উপর-উপর রিপোর্ট তৈরী করেছে, তলিয়ে না ভেবে। সে ডায়েরি থেকে মৃতার বাবার নাম্বার নিয়ে সেখানে একটা ফোন করলো।
"হ্যালো, আমি মুস্তাকিম , উত্তরা থানা থেকে বলছি।"
ওপাশে যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি চুপ করে রইলেন। মুস্তাকিম আবার বললো, "দেখুন, আপনাদের মানসিক অবস্থা এই মুহূর্তে স্বাভাবিক নয় জেনেও কেসের তদন্তের স্বার্থে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি।"
এবারে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে একটা ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর এলো, "বলুন, কী জানতে চান। আমরা নিজেরাও তো অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি, কোথায় আমাদের ভুল ছিলো, কীসের অভাব রেখেছিলাম আমরা -"
মুস্তাকিম একটু চুপ করে থেকে বললো, "দেখুন, আমি জানতে পারলাম আপনাদের পাড়ার কোনো একটি ছেলের সাথে আপনাদের মেয়েকে জড়িয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিলো।"
"হ্যাঁ, সে পুরোনো কথা। সেসব মিটমাট হয়ে যায় তারপর।"
"হ্যাঁ জানি সেটা। তো... কী নাম সেই ছেলেটার ?"
"ভিক্টর বলে ডাকি আমরা পাড়ায়। খুব সুবিধের নয় সে। কিন্তু কেন বলুন তো ?"
"ঠিক আছে, আমি পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি।"
ফোনটা রেখে দিলো মুস্তাকিম। তারপর আগন্তুককে বললো, "ঘটনাটা তো ঠিকই বলেছেন, বোঝা গেলো। ধরে নেওয়া যাক এই ছেলেটাই আপনার বন্ধু, মানে সাদিয়াকে, মেলায় ফলো করছিলো। তারপর তার সাথে ইলেকট্রিক নাগরদোলায় চড়ে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব অবাস্তব আর কাল্পনিক হয়ে যাচ্ছে না কি ? প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটার সঙ্গে যখন সাদিয়ার একটা ঝামেলা হয়েছিলো কোনো এক সময়ে, তো তার সাথেই নাগরদোলায় কেন সে চড়বে ? ছেলেটা অনুরোধ করলেই বা কেন চড়বে সে ? এটা ভীষণ অদ্ভুত নয় কি ?"
"কোনো মানুষ কী মুখোশ পরে আসে, সবসময় কি সেটা বোঝা যায় ? হয়তো সাদিয়া বিশ্বাস করেছিলো যে ছেলেটা সত্যিই অনুতপ্ত, হয়তো বাড়িতে মিথ্যে বলে মেলায় যাওয়ার কারণে একটু ভীতু ছিলো সে, সবার সামনে একটা সিন্ ক্রিয়েট করতে চায়নি।"
"হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার স্রেফ আজগুবি আর আপনার মনের অহেতুক সন্দেহ বলেই মনে হচ্ছে।"
আগন্তুক মেয়েটি তখন মুস্তাকিমর চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললো, "ছেলেটা অনুরোধ করলেও সাদিয়া নাহয় তার সাথে নাগরদোলায় চড়তে যাবে না। কিন্তু ধরুন যদি উল্টোটাই হয়ে থাকে ?"
নড়েচড়ে বসলো মুস্তাকিম। "আপনি কি বলছেন সাদিয়া নিজেই ছেলেটাকে নাগরদোলায় চড়বার প্রস্তাব দিয়েছিলো ? কেন ?"
"পুরোনো রাগ তো উভয়দিকেই থাকতে পারে, তাই না ? হয়তো প্রতিহিংসা নিতে চেয়েছিলো সাদিয়া।"
"কিন্তু আপনিই তো বললেন যে ছেলেটা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলো আর সেসব মিটমাট হয়ে গিয়েছিলো।"
"মিটমাট তো হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের সমাজে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কোনোভাবে জড়িয়ে পড়লে, তার মিটমাট বা মীমাংসা আসলে কার পক্ষে যায়, কাকে সেই ইতিহাস সর্বক্ষণ বহন করে চলতে হয়, আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অথবা, কে জানে, হয়তো আপনি সত্যিই জানেন না। আপনি বুঝবেন না। একমাত্র টিউশান যাওয়া ছাড়া সাদিয়ার বাইরে বেরোনো, ঘুরতে যাওয়া সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার পর থেকে। সাদিয়া হয়তো চেয়েছিলো তার এই গ্লানিকর ইতিহাসের জন্য যে দায়ী, তার উচিত শাস্তি হোক। তাই নাগরদোলার প্ল্যান।"
"দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি তো কাহিনীর পর কাহিনী ভেবে যাচ্ছেন। এটা কি বলিউডের স্ক্রিপ্ট লিখছেন নাকি, আশ্চর্য! আপনি বলছেন যে সাদিয়া নিজেই ছেলেটাকে নিয়ে নাগরদোলায় উঠেছিলো -"
"যাতে উপর থেকে সুযোগমতো তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে।" আগন্তুক সঙ্গে সঙ্গে মুস্তাকিমর কথাটাকে সম্পূর্ণ করলো। তারপর আবার বললো, "একটা মেয়ের কাছে তার সম্মান সবচেয়ে বড়ো জিনিষ। মেয়েদেরকে দূর্বল ভাববেন না । নিজের সম্মানে আঘাত লাগলে সে করতে পারে না এমন কাজ নেই।"
সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো মুস্তাকিমর। সে এই কথার পিঠে বললো, "তার মানে ছেলেটাকে মেলায় দেখে সাদিয়া তার উপর প্রতিশোধ নেবার ফন্দি আঁটে এবং তার সাথে নাগরদোলায় চড়ে। কিন্তু ধাক্কাধাক্কির সময় সে নিজেই পড়ে যায় বা ছেলেটি তাকে ধাক্কা মারে। তাইতো ?"
মেয়েটি কিছু বলে না, তার মুখ দেখে বোঝা যায় এটাই সে বলতে চেয়েছে।
মুস্তাকিম কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে একটু ভেবে শেষে বললো, "দেখুন, সবটাই তো সম্ভাবনার ব্যাপার। মানছি আপনি যেরকম বলছেন সেরকম হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অন্য কিছুও তো হয়ে থাকতে পারে।"
"না, এটাই হয়েছে। আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি।"
"আমি বুঝতে পারছি না", মুস্তাকিম বলে, "আপনি আপনার বন্ধুর পক্ষে বলছেন নাকি তার বিপক্ষে! খুন তার মানে আপনার বন্ধুই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে নিজেই খুন হয়ে যায় শেষে। বাহ্।"
মেয়েটি একটু মৃদু হাসে, "সাদিয়া যা চেয়েছিলো, তা শেষ অবধি করতে পারলো না। দেখুন, সাদিয়া তার ভুলের শাস্তি তো পেয়েছে, চরম শাস্তিই সে পেয়েছে। কিন্তু বলুন তো, ছেলেটার কোনো শাস্তি কি হবে না ? সাদিয়ার মতো একটা মেয়েকে এই জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যার কুকর্ম দায়ী, তার জন্য কোনো সাজা কি নেই আপনাদের আইনে ?"
মুস্তাকিম বললো, "আমরা আইনের রক্ষকমাত্র। আইনের বিচার আদালত করবে। সেটা আমাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। আমি আমার দিক থেকে এই কেস রিওপেন করে আবার ইনভেস্টিগেশন শুরু করছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করবো যাতে দোষী ঠিকই শাস্তি পায়। আপনি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছেন দেখছি। ভেরি গুড। আবার দরকার পড়লে তাহলে এই নাম্বারেই আমি কল করে নেবো আপনাকে।"
"নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তাহলে, আমি চলি।" আগন্তুক মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
"হ্যাঁ, আসুন।"
……………………………………………
মুস্তাকিম কেস ফাইলটা নিয়ে বসে দেখতে দেখতে ভাবছিলো। কীসব আজগুবি কাহিনী শুনিয়ে গেলো মেয়েটা। ঘটনাগুলো যেভাবে ব্যাখ্যা করলো সে, সেটা ঠিক হতেই পারে। কিন্তু ভাবনাগুলো যেন বড্ডো বেশী সাজানো-সাজানো। দুইয়ে দুইয়ে মিলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা এতো জোরের সাথে সবকিছু বলছিলো, যেন সে নিজে দেখেছে সব।
সত্যিই কি সে নিজে দেখেছে ? উঠে বসলো মুস্তাকিম। সেদিনকে মেলায় তারও যাওয়ার কথা ছিলো, বলছিলো মেয়েটা। হয়তো সত্যিই গিয়েছিলো, যা সে গোপন করে গেছে। আর তাহলে কি... কোনোভাবে এই দুর্ঘটনা বা খুনের সাথে সে যুক্ত থাকতে পারে ? নিজের ওপর থেকে সন্দেহের তীর অন্যদিকে ঘোরাবার জন্যই হয়তো -
কী মনে হতে কনষ্টেবল সাকিল ডাকলো মুস্তাকিম।
"এই একটু আগে যে মেয়েটা এসেছিলো, সে এখানে আরো দু'দিন এসেছে - কাল, পরশু ?"
"কই না তো স্যার।"
"তুমি শিওর ?"
"হ্যাঁ। আজই প্রথম দেখলাম। আসেনি তো আগে। বরং আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলো এখানের ও.সির নাম কী। আমি বললাম য।। সুমন অস্থায়ীভাবে বদলি হিসেবে ছিলেন, আপনার আজ ছুটি থেকে ফিরে আসার কথা। তো বললো অপেক্ষা করবে, দেখা করে যাবে।"
সাকিল্কে চলে যেতে বলে মুস্তাকিম কপালে হাত দিয়ে বসে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। আগন্তুক সম্ভবত তাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে গেছে। মেয়েটির পাঠানো ছবিগুলো আরও একবার ভালো করে দেখতে দেখতে মুস্তাকিম থানার ফোন থেকে একটা কল করলো মেয়েটির মোবাইলে। রিং হয়ে গেলো, কেউ ধরলো না। ধরবে না জানা কথা। তবু আরেকবার কল করলো সে। রিং হচ্ছে। কয়েকবার রিং হবার পর অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো, একটা বয়স্ক পুরুষকণ্ঠ। "হ্যালো -"
"আমি উত্তরা থানা থেকে বলছি, এটা কি আপনার ফোন ?"
"হ্যাঁ। আপনি কি মুস্তাকিম বিশ্বাস ? আপনার সঙ্গে কথা হলো তো একটু আগে। বলুন।"
"ওহ -", একটু হকচকিয়ে গেলো মুস্তাকিম। "আপনি -"
"আমি সাদিয়ার বাবা বলছি। আপনি আমার মেয়ের মোবাইলে ফোন করেছেন। ওর ঘরে রাখা ছিলো ফোনটা, তাই প্রথমবার এসে ধরবার আগেই কেটে যায়।"
………………………………
থানার ডায়েরিতে ঠিকানা লেখা ছিলো। গাড়ি নিয়ে সোজা সেখানে হাজির হলো মুস্তাকিম।
সাদিয়ার বাবা-মা মুস্তাকিমকে আপ্যায়ন করে বসালেন। বললেন, "ওই একটা মেয়েই তো আমাদের সবকিছু ছিলো। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো! এখনো যেন বিশ্বাস হয় না যে সে আর নেই। কী নিয়ে যে বাঁচবো আমরা বাকি দিনগুলো, জানি না।"
দৃশ্যতই তারা খুব বিষন্ন, দেখলো মুস্তাকিম। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরছে তখন। ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে সে বললো, "আপনার মেয়ের মোবাইলটা একটু দেখাতে পারেন ?"
"হ্যাঁ, আনছি।"
সাদিয়ার বাবা মেয়ের ঘর থেকে মোবাইলটা এনে দিলো মুস্তাকিমকে। মুস্তাকিম চিনতে পারলো। হুবহু এই ফোনটাই সে দেখেছে এই একটু আগে, থানাতে। এ কীকরে সম্ভব ?
একটু ভেবে মুস্তাকিম বললো, "আপনাদের মেয়ে হয়তো অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। কিছু নতুন তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। কিন্তু তার আগে... আপনাদের কাছে সাদিয়ার কোনো ছবি আছে নিশ্চয়ই ? একটা ছবি নিয়ে আসুন তো।"
অ্যাক্সিডেন্ট নয় !? সাদিয়ার মা এই কথায় ঠুকরে কেঁদে উঠলেন। কোনোরকমে চেয়ারের একটা হাতল ধরে বসে পড়লেন তিনি। সাদিয়ার বাবাও চিন্তিত মুখে ডাইনিংএর ফ্রিজের উপর থেকে একটা ফটোস্ট্যান্ড এনে মুস্তাকিমর সামনে রাখলেন। তাতে সাদিয়ার ছবি।
মুস্তাকিম অবাক হয়ে দেখলো, তার সন্দেহ মিথ্যে নয়। এই মেয়েটিই তার কাছে এসেছিলো একটু আগে। তার ছয় বছরের কেরিয়ারে এতো অদ্ভুত কেস সে আর দেখেনি। মেয়েটি তার কাহিনী নিজের মুখেই শুনিয়ে গেছে, মুস্তাকিম বুঝতেও পারেনি তখন। একটু যেন উদাস হয়ে গেলো সে। বহুদিন আগে পড়া বাংলা গল্পের একটা লাইন তার মাথায় এলো একটু অন্যভাবে - সাদিয়া মরিয়া প্রমান করিলো যে সে এমনি-এমনি মরে নাই।
ফটোটা স্ট্যান্ড থেকে বার করে হাতে নিয়ে মুস্তাকিম বয়স্ক মানুষটিকে বললো, "সাদিয়ার জন্য অনেক কিছু আপনারা করেছেন সারা জীবন। এবার তার আত্মার শান্তির জন্য যা করতে হয়, একটু ভালো করে করিয়ে নেবেন। যাইহোক এখন চলুন, ভিক্টরকে ধরতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো না।"
~ সমাপ্ত
এক সপ্তাহের লম্বা ছুটি থেকে ফিরে থানায় জয়েন করেই একটা ইন্টারেষ্টিং কেস হাতে পেলো মুস্তাকিম।
কোঁকড়ানো চুল, একটু শর্ট হাইটের মেয়েটি তারই অপেক্ষায় বসে ছিলো। মুখেচোখে বেশ একটা জৌলুশ আছে যা দু'বার ঘুরে দেখতে বাধ্য করে। মুস্তাকিমকে ঢুকতে দেখেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। "আপনিই কি ও.সি. মুস্তাকিম? "
"হ্যাঁ, বলুন কী ব্যাপার ?" মুস্তাকিম চেয়ার টেনে বসলো নিজের জায়গায়।
"দেখুন, আমি কাছাকাছি অঞ্চলেই থাকি। আপনি তো ছিলেন না গতকাল বা পরশু। আমি দুই দিন এসে এসে ফিরে গেছি। এখানে একটা ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে, শুনেছেন কিনা জানি না। একটা অ্যাক্সিডেন্ট এর ঘটনা -"
"সাদিয়া আহমেদের কেস?"
মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে বললো, "ওহ আপনি জানেন তাহলে ?"
"হ্যাঁ। ওভার দ্য ফোন শুনেছি। আপনি কী বলতে এসেছেন সেটা বলুন।" এই বলে মুস্তাকিম একজন পিওনকে সাদিয়ার ফাইলটা আনতে বললো। তারপর আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলো, "কী নাম আপনার ?"
"আমার নাম... দেখুন - আমি যেটা বলতে এসেছি তার সাথে হয়তো আমার নামের খুব একটা সম্পর্ক নেই। মানে আমার নাম বলতে কোনো অসুবিধা নেই। দরকার হলে বলবো। আমি একটা তথ্য আপনাকে দিতে এসেছি।"
মুস্তাকিম আগন্তুককে একবার দেখলো ভালো করে। তারপর বললো, "কী তথ্য ?"
"আমি... মানে সাদিয়া আর আমি ভালো বন্ধু ছিলাম আসলে। ফেসবুক থেকে আমাদের পরিচয়। তারপর খুব তাড়াতাড়িই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। মাঝে মাঝে একসাথে সিনেমায় বা শপিং-এ যেতাম দু'জনে মিলে। সাদিয়ার বাড়িতে কেউ জানতো না এই ব্যাপারে। ওর বাবা-মা খুব চোখে চোখে রাখতো । তো ঘুরতে গেলে বাড়িতে টিউশানের নাম করে বের হতো সাদিয়া। সেদিনও ওইরকমই বেরিয়েছিলো।"
মুস্তাকিম আঁচ করলো যে ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলজনক হয়ে উঠছে। সে সোজা হয়ে বসলো।
আগন্তুক বললো, "ঘটনার দিন সাদিয়া আমাকে বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছিলো। মেলার ছবি। মিলনমেলায় একাই গিয়েছিলো ও। আমার যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শেষমুহূর্তে অফিসে আটকে পড়ি। তো ও বাড়ি ফিরে না গিয়ে একাই যায় মেলায়। ওখানে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলো মেলার। আমাকে সেগুলো পাঠিয়েছিলো। তারপর ওর ফোন থেকে ছবিগুলো ডিলিট করে দেয়। বাড়ির ভয়ে। বাড়িতে জানতো না যে মেলায় যাবে। জানতো পড়তে যাচ্ছে। আপনারা নিশ্চয়ই ওর ফোন চেক করেছেন এবং কিছু পাননি। তাই আমি মেলার এই ছবিগুলো আপনাকে দেখাবার জন্য নিয়ে এসেছি। আপনার নাম শুনেছি অনেক -"
মেয়েটি তার ফোন থেকে কিছু ছবি বার করে মুস্তাকিমর সামনে রাখলো ফোনটা। তারপর বলতে থাকলো -
"সবাই এটাকে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু বলেই ধরছে। আমিও প্রথমে তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভালো করে এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে আমি একটা জিনিষ খেয়াল করলাম। দেখুন - বেশ কয়েকটা ছবিতে একটা গ্রীন কালারের টি-শার্ট পড়া ছেলেকে দেখা যাচ্ছে অনেক দূরে। মুখ তো বোঝা যাচ্ছে না ভালো। কয়েকটাতে মাথাও কাটা গেছে, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে যে সেই একই ব্যক্তি। আর সোজা এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে সবসময়।"
মুস্তাকিম ফোনটা নিয়ে ছবিগুলো দেখলো। কথাটা ভুল নয়। এই ছবিগুলো সত্যিই এই কেসটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারে। ইন্সপেক্টর সুমন তো এটাকে অ্যাক্সিডেন্টের কেস বলে ধরে নিয়ে ক্লোজ করে দিয়ে গেছেন।
আগন্তুক মেয়েটি বললো, "কেউ মনে হয় ওকে ফলো করছিলো। সাদিয়া বুঝতে পারেনি নিশ্চয়ই, নাহলে আমাকে বলতো তখনই। ফলো করছিলো মানে নিশ্চয়ই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো তার। এসব ভেবেই আমার মনে হলো যে এটা হয়তো শুধুই অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা নাও হতে পারে। কিছু রহস্য থাকলেও থাকতে পারে।আপনি কি মনে করেন?"
মুস্তাকিম তার পেশাগত দক্ষতায় মাথা নেড়ে বললো, "আমি বুঝতে পারছি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জন্য আপনি খুবই উদ্বিগ্ন। নানারকম কল্পনা আপনার মনে ঘুরছে হয়তো। কিন্তু মেলায় বহু লোক আসে আর সেখানে ছবি তুললে অনেকেই সেই ছবিতে এসে যেতে পারে। তার মধ্যে একজনকে বিশেষভাবে সন্দেহ করা - ব্যাপারটা যুক্তির দিক থেকে খুব ধারালো কি ?"
আগন্তুক একটু ভেবে বললো, "মেলায় মানুষ যায় আনন্দ করতে। যে যার মতো ঘোরাফেরা করে । এভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে না সবসময়। এগারোটা ছবির মধ্যে সাতটাতেই আমরা দেখতে পারছি সেই ব্যক্তি উপস্থিত। হয়তো এটা স্বাভাবিক, হয়তো নয়। কিন্তু একটু বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি কী ?"
মুস্তাকিম এবার জিজ্ঞাসা করলো, "আপনার আত্মপরিচয় দিতে না চাইবার কী কারণ আছে জানতে পারি কি ?"
"কিছুই না। দেখুন সাদিয়ার বাবা-মা আমার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এখন সাদিয়ার এভাবে মৃত্যুর পরে যদি তারা আমার সম্পর্কে জানতে পারেন, প্রথমতঃ তাদের চোখে সাদিয়া হয়তো খুব ছোট হয়ে যাবে। বাড়িতে গোপন করে এভাবে বিভিন্ন জায়গায় যেত। তাছাড়া, তারা আমাকেও সন্দেহ করতে পারেন। ভাববেন আমিই হয়তো কোনোভাবে যুক্ত। তাদের আমি দোষ দিতে পারি না। কতকিছুই তো ঘটছে সমাজের চারদিকে। সেখানে তারা আমাকে কীভাবেই বা বিশ্বাস করবেন ? সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম খিচুড়ি হয়ে যাবে। আমিও তো একজন মেয়ে, তারা আমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে থাকলে আমার বাড়িতেও সমস্যা তৈরী হবে। আমি শুধু চাই, যদি সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকে, তো সে চিহ্নিত হোক এবং শাস্তি পাক।"
"আপনি চাকরি করেন বললেন, তাই না ? কোথায় জব আপনার ?" মুস্তাকিম জিজ্ঞাসা করলো।
"আমি গ্রাজুয়েশনের সাথে সাথে পার্টটাইম জব করছি একটা ফার্মে কিছুদিন হলো। অমেইক আইটি । হাউসবিল্ডিং কাছে আমার অফিস।"
মুস্তাকিম মেয়েটিকে অভয় দিয়ে বললো, "ঠিক আছে, আপনার পরিচয় গোপন রাখা আমার দায়িত্ব রইলো। চিন্তা করবেন না, আমি দেখে নিচ্ছি। আপনার সামনে আমার নাম্বার লেখা আছে দেখুন। আপনি ছবিগুলো এই নাম্বারে পাঠিয়ে দিন ততক্ষণে। "
…………………………………………………………
মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে কেস ফাইলটা খুললো মুস্তাকিম। সে যখন ছুটিতে গিয়েছিলো, । সুমন অস্থায়ীভাবে তার জায়গায় ছিলেন। ফাইলে তারই হস্তাক্ষর।
গত বুধবারের ঘটনা। নাম সাদিয়া সাহা। বয়স বাইশ। পাঁচ ফুট দু'ইঞ্চি হাইট। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নাগরদোলা থেকে পড়ে মৃত্যু। উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলা বা হুইল বলা হয় যাকে। পুলিশ রিপোর্ট বলছে, মৃতার বাবার তরফ থেকে থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে বিকেল চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। মুখ-চোখ সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে, থেঁতলে গেছে। সেই ছবিই সাঁটানো আছে ফাইলে। পুলিশি অ্যাকশান বলতে, ওই মেলাপ্রাঙ্গনে সব নাগরদোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে ইলেকট্রিক নাগরদোলা থেকে পড়ে সাদিয়া সাহার মৃত্যু হয়েছে, সেই নাগরদোলার মালিক পলাতক। নাম হাফিজ । বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। নাগরদোলা কোথাও ভাঙেনি বা কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে যে সীট থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে সাদিয়ার, তার সেফটি লকটা খোলা ছিলো। কীভাবে খুললো, সেটা বোঝা যায়নি যদিও। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, মস্তিষ্কে তীব্র আঘাত লাগা থেকে মৃত্যু ঘটেছে। কোনো উঁচু জায়গা থেকে পড়লে যা হতে পারে।
এগুলো সবই জানা ছিলো মুস্তাকিমর। থানা থেকে ফোনে বিস্তারিত খবর দেওয়া হয়েছিলো। ইন্সপেক্টর সুমন তার সাথে আলোচনাও করেছিলেন যখন মুস্তাকিম ছুটিতে ছিলো গত সপ্তাহে। তবু ফাইলটা খুলে নাড়াচাড়া করছিলো সে। একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সে, "কোনো বয়ফ্রেন্ড বা ওরকম কোনো রিলেশান কি ছিলো সাদিয়ার ?"
"দেখুন, আমি তো সেরকম জানি না। যদিও মেয়েরা এই ব্যাপারে খুব অন্তর্মুখীন হয়, তবু কিছু থাকলে আমাকে অন্তত বলতোই। না, সেরকম কোনো রিলেশানে ছিলো না ও।"
"তাহলে আপনি যে বলছেন এটা অ্যাক্সিডেন্ট নাও হতে পারে, হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে, তার তো কোনো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেন এরকম করবে ?"
মেয়েটি একটু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ছিলো একজন। ঠিক কোনো সম্পর্ক নয়। ওদের পাড়ারই ছেলে। সাদিয়ার থেকে বয়সে বেশ বড়ো। সাদিয়ার সাথে জোরজবরদস্তি করবার চেষ্টা করেছিলো একবার, পুজোর সময়। বেশ ঝামেলা হয়েছিলো সেবার। আর ছেলেটাকে খুব অপমান করেছিলো সাদিয়া। কিন্তু পরে ছেলেটা বাড়িতে এসে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ব্যাপারটা দুই বাড়ির মধ্যে মিটমাটও হয়ে গিয়েছিলো। তবু পুরোনো রাগ থেকে থাকতেই পারে।"
"আপনি বলছেন সেই ছেলেটাই এই মেলায় গিয়েছিলো আর সাদিয়াকে ইলেকট্রিক নাগরদোলা থেকে সে-ই ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ? কোনো সাক্ষ্য প্রমান কিছু কিন্তু নেই। রিপোর্টে আমি যা দেখছি, প্রতক্ষ্যদর্শীদের বয়ানমতো, মেয়েটি নাগরদোলার সীটে একাই ছিলো, তার সাথে কেউ ছিলো না।"
আগন্তুক মেয়েটি একটু মৃদু হেসে বললো, "ভেবে দেখুন, একটা বিশাল উঁচু নাগরদোলা খুব জোরে ঘুরছে। সেখান থেকে কেউ ছিটকে পড়লে, লোকে তো তার দিকেই দেখবে আতঙ্কে! কোথা থেকে পড়লো, কীভাবে পড়লো, কে নজর করে দেখছে ? অধিকাংশজনই তো দেখতে পাবে পড়ার পরে। সঙ্গে কেউ ছিলো কি ছিলো না এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে কেউ নিজে থেকে এগিয়ে এলো কিনা সঙ্গী হিসাবে। কেউ আসেনি, তার মানে কেউ সাথে ছিলো না। এভাবেই ভাববে মানুষ, তাই না ?"
মুস্তাকিম ভেবে দেখলো, কথাটা ঠিক। পুলিশ খুব উপর-উপর রিপোর্ট তৈরী করেছে, তলিয়ে না ভেবে। সে ডায়েরি থেকে মৃতার বাবার নাম্বার নিয়ে সেখানে একটা ফোন করলো।
"হ্যালো, আমি মুস্তাকিম , উত্তরা থানা থেকে বলছি।"
ওপাশে যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি চুপ করে রইলেন। মুস্তাকিম আবার বললো, "দেখুন, আপনাদের মানসিক অবস্থা এই মুহূর্তে স্বাভাবিক নয় জেনেও কেসের তদন্তের স্বার্থে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি।"
এবারে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে একটা ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর এলো, "বলুন, কী জানতে চান। আমরা নিজেরাও তো অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি, কোথায় আমাদের ভুল ছিলো, কীসের অভাব রেখেছিলাম আমরা -"
মুস্তাকিম একটু চুপ করে থেকে বললো, "দেখুন, আমি জানতে পারলাম আপনাদের পাড়ার কোনো একটি ছেলের সাথে আপনাদের মেয়েকে জড়িয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিলো।"
"হ্যাঁ, সে পুরোনো কথা। সেসব মিটমাট হয়ে যায় তারপর।"
"হ্যাঁ জানি সেটা। তো... কী নাম সেই ছেলেটার ?"
"ভিক্টর বলে ডাকি আমরা পাড়ায়। খুব সুবিধের নয় সে। কিন্তু কেন বলুন তো ?"
"ঠিক আছে, আমি পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি।"
ফোনটা রেখে দিলো মুস্তাকিম। তারপর আগন্তুককে বললো, "ঘটনাটা তো ঠিকই বলেছেন, বোঝা গেলো। ধরে নেওয়া যাক এই ছেলেটাই আপনার বন্ধু, মানে সাদিয়াকে, মেলায় ফলো করছিলো। তারপর তার সাথে ইলেকট্রিক নাগরদোলায় চড়ে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব অবাস্তব আর কাল্পনিক হয়ে যাচ্ছে না কি ? প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটার সঙ্গে যখন সাদিয়ার একটা ঝামেলা হয়েছিলো কোনো এক সময়ে, তো তার সাথেই নাগরদোলায় কেন সে চড়বে ? ছেলেটা অনুরোধ করলেই বা কেন চড়বে সে ? এটা ভীষণ অদ্ভুত নয় কি ?"
"কোনো মানুষ কী মুখোশ পরে আসে, সবসময় কি সেটা বোঝা যায় ? হয়তো সাদিয়া বিশ্বাস করেছিলো যে ছেলেটা সত্যিই অনুতপ্ত, হয়তো বাড়িতে মিথ্যে বলে মেলায় যাওয়ার কারণে একটু ভীতু ছিলো সে, সবার সামনে একটা সিন্ ক্রিয়েট করতে চায়নি।"
"হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার স্রেফ আজগুবি আর আপনার মনের অহেতুক সন্দেহ বলেই মনে হচ্ছে।"
আগন্তুক মেয়েটি তখন মুস্তাকিমর চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললো, "ছেলেটা অনুরোধ করলেও সাদিয়া নাহয় তার সাথে নাগরদোলায় চড়তে যাবে না। কিন্তু ধরুন যদি উল্টোটাই হয়ে থাকে ?"
নড়েচড়ে বসলো মুস্তাকিম। "আপনি কি বলছেন সাদিয়া নিজেই ছেলেটাকে নাগরদোলায় চড়বার প্রস্তাব দিয়েছিলো ? কেন ?"
"পুরোনো রাগ তো উভয়দিকেই থাকতে পারে, তাই না ? হয়তো প্রতিহিংসা নিতে চেয়েছিলো সাদিয়া।"
"কিন্তু আপনিই তো বললেন যে ছেলেটা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলো আর সেসব মিটমাট হয়ে গিয়েছিলো।"
"মিটমাট তো হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের সমাজে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কোনোভাবে জড়িয়ে পড়লে, তার মিটমাট বা মীমাংসা আসলে কার পক্ষে যায়, কাকে সেই ইতিহাস সর্বক্ষণ বহন করে চলতে হয়, আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অথবা, কে জানে, হয়তো আপনি সত্যিই জানেন না। আপনি বুঝবেন না। একমাত্র টিউশান যাওয়া ছাড়া সাদিয়ার বাইরে বেরোনো, ঘুরতে যাওয়া সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার পর থেকে। সাদিয়া হয়তো চেয়েছিলো তার এই গ্লানিকর ইতিহাসের জন্য যে দায়ী, তার উচিত শাস্তি হোক। তাই নাগরদোলার প্ল্যান।"
"দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি তো কাহিনীর পর কাহিনী ভেবে যাচ্ছেন। এটা কি বলিউডের স্ক্রিপ্ট লিখছেন নাকি, আশ্চর্য! আপনি বলছেন যে সাদিয়া নিজেই ছেলেটাকে নিয়ে নাগরদোলায় উঠেছিলো -"
"যাতে উপর থেকে সুযোগমতো তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে।" আগন্তুক সঙ্গে সঙ্গে মুস্তাকিমর কথাটাকে সম্পূর্ণ করলো। তারপর আবার বললো, "একটা মেয়ের কাছে তার সম্মান সবচেয়ে বড়ো জিনিষ। মেয়েদেরকে দূর্বল ভাববেন না । নিজের সম্মানে আঘাত লাগলে সে করতে পারে না এমন কাজ নেই।"
সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো মুস্তাকিমর। সে এই কথার পিঠে বললো, "তার মানে ছেলেটাকে মেলায় দেখে সাদিয়া তার উপর প্রতিশোধ নেবার ফন্দি আঁটে এবং তার সাথে নাগরদোলায় চড়ে। কিন্তু ধাক্কাধাক্কির সময় সে নিজেই পড়ে যায় বা ছেলেটি তাকে ধাক্কা মারে। তাইতো ?"
মেয়েটি কিছু বলে না, তার মুখ দেখে বোঝা যায় এটাই সে বলতে চেয়েছে।
মুস্তাকিম কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে একটু ভেবে শেষে বললো, "দেখুন, সবটাই তো সম্ভাবনার ব্যাপার। মানছি আপনি যেরকম বলছেন সেরকম হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অন্য কিছুও তো হয়ে থাকতে পারে।"
"না, এটাই হয়েছে। আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি।"
"আমি বুঝতে পারছি না", মুস্তাকিম বলে, "আপনি আপনার বন্ধুর পক্ষে বলছেন নাকি তার বিপক্ষে! খুন তার মানে আপনার বন্ধুই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে নিজেই খুন হয়ে যায় শেষে। বাহ্।"
মেয়েটি একটু মৃদু হাসে, "সাদিয়া যা চেয়েছিলো, তা শেষ অবধি করতে পারলো না। দেখুন, সাদিয়া তার ভুলের শাস্তি তো পেয়েছে, চরম শাস্তিই সে পেয়েছে। কিন্তু বলুন তো, ছেলেটার কোনো শাস্তি কি হবে না ? সাদিয়ার মতো একটা মেয়েকে এই জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যার কুকর্ম দায়ী, তার জন্য কোনো সাজা কি নেই আপনাদের আইনে ?"
মুস্তাকিম বললো, "আমরা আইনের রক্ষকমাত্র। আইনের বিচার আদালত করবে। সেটা আমাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। আমি আমার দিক থেকে এই কেস রিওপেন করে আবার ইনভেস্টিগেশন শুরু করছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করবো যাতে দোষী ঠিকই শাস্তি পায়। আপনি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছেন দেখছি। ভেরি গুড। আবার দরকার পড়লে তাহলে এই নাম্বারেই আমি কল করে নেবো আপনাকে।"
"নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তাহলে, আমি চলি।" আগন্তুক মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
"হ্যাঁ, আসুন।"
……………………………………………
মুস্তাকিম কেস ফাইলটা নিয়ে বসে দেখতে দেখতে ভাবছিলো। কীসব আজগুবি কাহিনী শুনিয়ে গেলো মেয়েটা। ঘটনাগুলো যেভাবে ব্যাখ্যা করলো সে, সেটা ঠিক হতেই পারে। কিন্তু ভাবনাগুলো যেন বড্ডো বেশী সাজানো-সাজানো। দুইয়ে দুইয়ে মিলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা এতো জোরের সাথে সবকিছু বলছিলো, যেন সে নিজে দেখেছে সব।
সত্যিই কি সে নিজে দেখেছে ? উঠে বসলো মুস্তাকিম। সেদিনকে মেলায় তারও যাওয়ার কথা ছিলো, বলছিলো মেয়েটা। হয়তো সত্যিই গিয়েছিলো, যা সে গোপন করে গেছে। আর তাহলে কি... কোনোভাবে এই দুর্ঘটনা বা খুনের সাথে সে যুক্ত থাকতে পারে ? নিজের ওপর থেকে সন্দেহের তীর অন্যদিকে ঘোরাবার জন্যই হয়তো -
কী মনে হতে কনষ্টেবল সাকিল ডাকলো মুস্তাকিম।
"এই একটু আগে যে মেয়েটা এসেছিলো, সে এখানে আরো দু'দিন এসেছে - কাল, পরশু ?"
"কই না তো স্যার।"
"তুমি শিওর ?"
"হ্যাঁ। আজই প্রথম দেখলাম। আসেনি তো আগে। বরং আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলো এখানের ও.সির নাম কী। আমি বললাম য।। সুমন অস্থায়ীভাবে বদলি হিসেবে ছিলেন, আপনার আজ ছুটি থেকে ফিরে আসার কথা। তো বললো অপেক্ষা করবে, দেখা করে যাবে।"
সাকিল্কে চলে যেতে বলে মুস্তাকিম কপালে হাত দিয়ে বসে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। আগন্তুক সম্ভবত তাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে গেছে। মেয়েটির পাঠানো ছবিগুলো আরও একবার ভালো করে দেখতে দেখতে মুস্তাকিম থানার ফোন থেকে একটা কল করলো মেয়েটির মোবাইলে। রিং হয়ে গেলো, কেউ ধরলো না। ধরবে না জানা কথা। তবু আরেকবার কল করলো সে। রিং হচ্ছে। কয়েকবার রিং হবার পর অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো, একটা বয়স্ক পুরুষকণ্ঠ। "হ্যালো -"
"আমি উত্তরা থানা থেকে বলছি, এটা কি আপনার ফোন ?"
"হ্যাঁ। আপনি কি মুস্তাকিম বিশ্বাস ? আপনার সঙ্গে কথা হলো তো একটু আগে। বলুন।"
"ওহ -", একটু হকচকিয়ে গেলো মুস্তাকিম। "আপনি -"
"আমি সাদিয়ার বাবা বলছি। আপনি আমার মেয়ের মোবাইলে ফোন করেছেন। ওর ঘরে রাখা ছিলো ফোনটা, তাই প্রথমবার এসে ধরবার আগেই কেটে যায়।"
………………………………
থানার ডায়েরিতে ঠিকানা লেখা ছিলো। গাড়ি নিয়ে সোজা সেখানে হাজির হলো মুস্তাকিম।
সাদিয়ার বাবা-মা মুস্তাকিমকে আপ্যায়ন করে বসালেন। বললেন, "ওই একটা মেয়েই তো আমাদের সবকিছু ছিলো। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো! এখনো যেন বিশ্বাস হয় না যে সে আর নেই। কী নিয়ে যে বাঁচবো আমরা বাকি দিনগুলো, জানি না।"
দৃশ্যতই তারা খুব বিষন্ন, দেখলো মুস্তাকিম। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরছে তখন। ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে সে বললো, "আপনার মেয়ের মোবাইলটা একটু দেখাতে পারেন ?"
"হ্যাঁ, আনছি।"
সাদিয়ার বাবা মেয়ের ঘর থেকে মোবাইলটা এনে দিলো মুস্তাকিমকে। মুস্তাকিম চিনতে পারলো। হুবহু এই ফোনটাই সে দেখেছে এই একটু আগে, থানাতে। এ কীকরে সম্ভব ?
একটু ভেবে মুস্তাকিম বললো, "আপনাদের মেয়ে হয়তো অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। কিছু নতুন তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। কিন্তু তার আগে... আপনাদের কাছে সাদিয়ার কোনো ছবি আছে নিশ্চয়ই ? একটা ছবি নিয়ে আসুন তো।"
অ্যাক্সিডেন্ট নয় !? সাদিয়ার মা এই কথায় ঠুকরে কেঁদে উঠলেন। কোনোরকমে চেয়ারের একটা হাতল ধরে বসে পড়লেন তিনি। সাদিয়ার বাবাও চিন্তিত মুখে ডাইনিংএর ফ্রিজের উপর থেকে একটা ফটোস্ট্যান্ড এনে মুস্তাকিমর সামনে রাখলেন। তাতে সাদিয়ার ছবি।
মুস্তাকিম অবাক হয়ে দেখলো, তার সন্দেহ মিথ্যে নয়। এই মেয়েটিই তার কাছে এসেছিলো একটু আগে। তার ছয় বছরের কেরিয়ারে এতো অদ্ভুত কেস সে আর দেখেনি। মেয়েটি তার কাহিনী নিজের মুখেই শুনিয়ে গেছে, মুস্তাকিম বুঝতেও পারেনি তখন। একটু যেন উদাস হয়ে গেলো সে। বহুদিন আগে পড়া বাংলা গল্পের একটা লাইন তার মাথায় এলো একটু অন্যভাবে - সাদিয়া মরিয়া প্রমান করিলো যে সে এমনি-এমনি মরে নাই।
ফটোটা স্ট্যান্ড থেকে বার করে হাতে নিয়ে মুস্তাকিম বয়স্ক মানুষটিকে বললো, "সাদিয়ার জন্য অনেক কিছু আপনারা করেছেন সারা জীবন। এবার তার আত্মার শান্তির জন্য যা করতে হয়, একটু ভালো করে করিয়ে নেবেন। যাইহোক এখন চলুন, ভিক্টরকে ধরতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো না।"
~ সমাপ্ত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন